রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১০:৫৫ অপরাহ্ন

স্যালাইন স্ট্যান্ডের দাম ৬০ হাজার টাকা

স্যালাইন স্ট্যান্ডের দাম ৬০ হাজার টাকা

স্বদেশ ডেস্ক:

উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনাতেই এখন দুর্নীতির ভূত। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকল্প প্রস্তাবনাতে ব্যয় প্রাক্কলনে কোনো ধরনের নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের পর অতিরঞ্জিত ব্যয় প্রাক্কলনে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা দিয়েছে। মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টার প্রকল্পে স্যালাইন ঝুলানোর জন্য স্ট্যান্ডের দাম ধরা হয়েছে ৬০ হাজার টাকা। আর চেহারা দেখার জন্য লুকিং গ্লাসের দাম ধরা হয়েছে ২০ হাজার টাকা। এগুলোকে সাগরচুরি বললেও কম বলা হবে। নিয়ম থাকা সত্ত্বেও বড় ব্যয়ের প্রকল্পগুলোতে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হচ্ছে না। প্রকল্প আইনের অনেক কিছুই পাস কাটিয়ে প্রস্তাবনা পাঠানো হচ্ছে পরিকল্পনা কমিশনে। প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভায় (পিইসি) এসব অস্বাভাবিক ব্যয় প্রস্তাবনা নিয়ে চরমভাবে অসন্তোষ প্রকাশ করে স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে ব্যাখ্যাও চাওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৫০ শয্যার ও জেলা সদর হাসপাতালে ১০ শয্যার কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টার স্থাপন প্রকল্পে সম্প্রতি পিইসি সভা হয়। তাতে এসব অতিরঞ্জিত ব্যয় প্রস্তাবনা বেরিয়ে আসে। প্রথম পর্যায়ে এ প্রকল্পের ব্যয় প্রায় সোয়া ৬০০ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েেিছল। কিন্তু গত মে মাসের পিইসি সভায় ওই ব্যয় ৩৬৯ কোটি টাকা কমিয়ে নতুন ব্যয় প্রস্তাব করা হয় ২৫৩ কোটি ২ লাখ টাকা। প্রকল্পটি চলতি বছর অনুমোদন পেলে আগামী ২০২২ সালের জুনে সমাপ্ত করার কথা ছিল। চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দবিহীন অননুমোদিত নতুন প্রকল্পের তালিকায় এটি অন্তর্ভুক্ত আছে।

পিইসি সভায় ডিপিপির ব্যয় বিশ্লেষণে দেখা যায়, আসবাবপত্র কেনা বাবদ ১০ কোটি ৮১ লাখ টাকা এবং যন্ত্রপাতি সংগ্রহ বাবদ ২২০ কোটি ৮১ লাখ টাকা ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে। যন্ত্রপাতি ও আসবাবপত্রের ব্যয় প্রাক্কলনে বড় ধরনের অসঙ্গতি পাওয়া গেছে। এতে স্যালাইন স্ট্যান্ডের দাম কোনো কোনো হাসপাতালের জন্য তিন হাজার টাকা এবং কোনো কোনো হাসপাতালের জন্য ৬০ হাজার টাকা ধরা হয়েছে। আবার লুকিং গ্লাসের মূল্য কোথাও পাঁচ হাজার টাকা আবার কোথাও ২০ হাজার টাকা ধরা হয়েছে। সোফার দাম ধরা হয়েছে কোথাও ৩ হাজার টাকা আবার কোথাও এক লাখ টাকা। এ ছাড়া এমএসআর কেনার ক্ষেত্রে দর প্রাক্কলনে এবং এসএসআর অন্তর্ভুক্ত সামগ্রীতে বড় রকমের অসঙ্গতি পাওয়া গেছে। যেমন ৪৭টি প্রকল্প স্থাপনের জন্য মোট ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫০ কোটি এক লাখ টাকা। এরূপ ব্যয় প্রাক্কলনের বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনের কাছে ডিপিপি প্রেরণ করায় সংশ্লিষ্ট পিইসি সভায় ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়।

পর্যালোচনায় বেরিয়ে আসে, যন্ত্রপাতি ও আসবাবপত্রের পাশাপাশি কম্পিউটার ও আনুষঙ্গিক বাবদ এক কোটি ৭৯ লাখ টাকা ব্যয় প্রাক্কলন করা হলেও এর কোনো বিভাজন দেয়া হয়নি। ডিপিপিতে কোনো ব্যাখ্যা বা বর্ণনা প্রদান করা হয়নি। ওই অঙ্গসহ বিজ্ঞাপন, ডাক, কাস্টমস শুল্কসহ সব রাজস্ব ব্যয়ের প্রাক্কলনও যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করা প্রয়োজন। এ ছাড়া স্ট্যাম্প, সিল ও স্টেশনারি অঙ্গে বিভিন্ন আইটেমের ব্র্যান্ড নাম উল্লেখ করা হয়েছে, যা পিপিআরের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তাই এটি সংশোধন করা প্রয়োজন।

পিইসি সভা থেকে বলা হয়েছে, ডিপিপিতে দুই ধরনের ক্রয় পরিকল্পনা প্রদান করা হয়েছে, যা বিভ্রান্তিমূলক। নির্মাণকাজের ক্রয় অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ এ দুই ক্রয় পরিকল্পনায় দুই প্রকার এবং পণ্য ও কার্যের ব্যয় বিভাজন দুই ক্রয় পরিকল্পনায় দুই রকম। এ ছাড়া জনবল আউটসোর্সিং করা হলে সেবার ক্রয় পরিকল্পনায় তা প্রদর্শন করার নিয়ম রয়েছে। সামগ্রিকভাবে ক্রয় পরিকল্পনা সংশোধন করা আবশ্যক বলে পিইসি সভায় একমত পোষণ করা হয়।

জানা গেছে, প্রকল্পের আওতায় প্রকল্প পরিচালকের জন্য ৯১ কোটি ৬৭ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি জিপ এবং প্রকল্পের মালামাল পরিবহনের জন্য ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি ডাবল কেবিন পিকআপ ক্রয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। যেহেতু কোনো নির্মাণকাজ এ প্রকল্পের আওতায় গ্রহণ করা হবে না, সেহেতু ডাবল কেবিন পিকআপ কেনার প্রস্তাব বাদ দেয়া উচিত। আর প্রস্তাবিত জিপের মূল্য অর্থবিভাগের সর্বশেষ সার্কুলার অনুযায়ী প্রস্তাব করার জন্য পিইসি থেকে বলা হয়েছে। এ ছাড়া যন্ত্রপাতি, আসবাবপত্র ও এমএসআরের পরিমাণ, ধরন ও প্রাক্কলিত ব্যয় মন্ত্রণালয় পর্যায়ে গঠিত কমিটি কর্তৃক প্রাক্কলনকৃত ও প্রত্যায়িত হতে হবে।

পরিকল্পনা কমিশন বলছে, ২৫ কোটি টাকার বেশি কোনো বিনিয়োগ প্রকল্পের ক্ষেত্রে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের আবশ্যকতা রয়েছে। যদিও প্রকল্প ব্যয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে, তার পরও সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদনটি পরীক্ষান্তে বেশ কিছু ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়েছে। কেবল পরিদর্শন, কর্মশালা ও মতামত গ্রহণে মাধ্যমে সম্ভাব্যতা সমীক্ষাটি সম্পন্ন করা হয়েছে। আর মে মাসের পিইসি সভা থেকে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করার নির্দেশনার প্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের প্রতিবেদন যুক্ত করা হয়েছে। পুরনো সম্ভাব্যতা যাচাইকে বর্তমান প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদন হিসেবে গণ্য করার চেষ্টা প্রতীয়মান। এ ধরনের সমীক্ষা ডিপিপিতে যুক্ত করা কাম্য নয় বলে আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগ থেকে বলা হয়েছে। এনইসি, একনেক ও সমন্বয় অনুবিভাগ বলছে, সম্ভাব্যতা সমীক্ষার ফরম্যাট অনুসারে এটি করা হয়নি। সরকারি খাতে উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, প্রক্রিয়াকরণ, অনুমোদন ও সংশোধনসংক্রান্ত পরিপত্র অনুসরণ ছাড়া সম্পাদন করা হয়েছে সমীক্ষাটি।

প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা গেছে, দেশের মোট ৪৭টি জেলাকে প্রকল্প এলাকা হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। ডিপিপিতে কোন কোন জেলায় কত শয্যার কেন্দ্র স্থাপন করা হবে, তা স্পষ্ট নয়। এভাবে স্থান নির্ধারণের ফলে এক দিকে রাঙ্গামাটি, নওগাঁ, নীলফামারী, হবিগঞ্জসহ সাতটি জেলায় একাধিক কেন্দ্র স্থাপন করার জন্য প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।

এ দিকে স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, মৌলভীবাজার জেলায় এরই মধ্যে ১৭টি ডায়ালাইসিস মেশিন রয়েছে। কিন্তু জনবলের অভাবে তা পরিচালনা করা যাচ্ছে না। অন্য যেসব জেলায় এ মেশিন আছে সেখানেও প্রশিক্ষিত জনবলের অভাবে সেগুলো সংস্থাপন ও পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে মূল্যবান যন্ত্রপাতিগুলো পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে। ওয়ারেন্টি সময় শেষ হয়ে যাওয়ার অভিযোগও এরই মধ্যে প্রমাণিত হয়েছে।

মিরপুরের ৬ নম্বর সেকশনের বিভিন্ন মেটাল পণ্য তৈরির দোকানের মালিকদের সাথে আলাপকালে তারা জানান, তিন সুতার ডিফম্বার রড দিয়ে যেসব স্যালাইন স্ট্যান্ড বানানো হয় তাতে সর্বোচ্চ এক হাজার ২০০ টাকা খরচ হয়। আর স্টেইনলেস স্টিল দিয়ে বানানো হলে সর্বোচ্চ আড়াই হাজার টাকার মতো হবে। প্রতিটির দর ৬০ হাজার টাকা শুনে তাদের চোখ যেন ছানাবড়া। মিরপুর জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে কাপড় রাখার উন্নতমানের বিভিন্ন হ্যাঙ্গারের দাম সর্বোচ্চ সাড়ে তিন হাজার থেকে চার হাজার টাকা দর দেখা গেছে।

অন্য দিকে বিএমএ ভবনের পাশে অবস্থিত সার্জিক্যাল ও মেডিক্যাল যন্ত্রপাতির মার্কেটের দোকানদারদের সাথে আলাপকালে তারা জানান, এত দাম হবে যদি স্বর্ণের প্রলেপ দেয়া থাকে। সম্প্রতি হাসপাতালের বিভিন্ন প্রকল্পের পণ্য কেনার যে দর আমরা মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পারছি তাতে আমরা ভাষা হারিয়ে ফেলছি। আমাদের পণ্যে শুল্ক ও ট্যাক্স যে হারে বাড়ানো হয়েছে, তাতেও মেডিক্যাল যন্ত্রপাতির দাম এতটা হওয়ার নয়। এগুলো রাষ্ট্রের ও জনগণের ট্যাক্সের টাকা আত্মসাৎ করা ছাড়া আর কিছুই না।

এ প্রকল্পের ব্যাপারে আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগের স্বাস্থ্য উইংয়ের যুগ্ম প্রধান সাজিদা খাতুনের মতামত চাইলে তিনি কোনো ধরনের মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।

এ প্রকল্পের ব্যাপারে আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) আবুল কালাম আজাদের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি নয়া দিগন্তকে জানান, ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি করে ডিপিপি পাঠাতে বলা হয়েছে। কারণ এখানে সব জেলায় এক রকম ডায়ালাইসিস সেন্টারের প্রয়োজন হবে না। এখানে ছোট ও বড় জেলা রয়েছে। তাই সম্ভাব্যতা যাচাই করা হলে প্রকৃত চিত্রটা পাওয়া যাবে। আর সে আলোকে প্রকল্প প্রণয়ন করা হলে সঠিকভাবেই করা হবে। তিনি বলেন, এখানে প্রস্তাবনায় পণ্যের দাম কম-বেশি আছে। তাই বাজার যাচাই করে পণ্যমূল্য প্রাক্কলন করতে বলা হয়েছে। কারণ প্রকল্পটি একনেকে উপস্থাপন করা হলে প্রধানমন্ত্রী বিষয়গুলো জানতে চাইলে তাকে যেন সঠিকভাবে অবহিত করা যায়। এ ছাড়া পণ্যের গুণগত মানের ওপরও পণ্যমূল্য নির্ভর করে। জাপানি পণ্য এবং অন্য দেশের পণ্যের দাম এক হবে না। এ ছাড়া বাস্তবায়নকারী সংস্থা কোন পণ্য কিনবে সেটি তাদের ওপর নির্ভর করে। তাই আমরা বাজারে সাথে সামঞ্জস্যতা বিধান করে দর দিতে বলেছি।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877